আপনার মস্তিষ্কের বয়স কত এবং কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
মস্তিষ্কের বয়স নিয়ে অনেকের ধারণা নাও থাকতে পারে তবে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এক নতুন কৌশল, যেটা থেকে জানা যেতে পারে মানুষের মস্তিষ্কের বয়স কত, কিছু কিছু সময় কম বয়সী মানুষদের অধিক মস্তিষ্কের বয়স হয়ে থাকে আবার কিছু বয়স্ক মানুষদের মস্তিষ্কের বয়স খুবই কম হয়ে থাকে, উদাহরণস্বরূপ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বয়স বর্তমানে ৩৯ বছর প্রায় কিন্তু বিজ্ঞানীরা তার মস্তিষ্কে পরীক্ষা করে দেখেছেন তার মস্তিষ্কের বয়স আসলে ২২ থেকে ২৫ বছর, আমাদের জীবনধারার নানা পরিবর্তন অভ্যাস এবং মানসিক চর্চা মস্তিষ্কের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
আমরা সবাই বয়স বাড়তে দেখলেও মস্তিষ্কের বয়স ধরা খুবই জটিল ব্যাপার। আপনি কি জানেন আপনার মস্তিষ্কের বয়স আসলে আপনার প্রকৃত বয়সের চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে? আপনার দৈনন্দিন কিছু বদ অভ্যাসের কারণে রীতিমত মস্তিষ্কের বয়স বৃদ্ধি করেছেন যেটাতে আপনার কর্মজীবনে খুব বেশি প্রভাবিত করছে, চলুন আমাদের এই পোষ্টের মাধ্যমে আমরা আপনাকে জানাবো কিভাবে আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং মানসিক চর্চা মস্তিষ্কের বয়স প্রভাবিত করে। একইসাথে কিছু সহজ কৌশলও শিখব, যা আমাদের মস্তিষ্কের বয়স কমাতে সাহায্য করতে পারে।
মস্তিষ্কের বয়স কীভাবে নির্ধারিত হয়?
মূলত মস্তিষ্কের বয়স ধরা হয় নানা মানসিক এবং শারীরিক উপাদানের মাধ্যমে কোন একটা বিষয়ে আপনি কি চিন্তা করছেন এবং কিরূপ মন্তব্য করছেন সেটার উপর নির্ভর করে আপনার মস্তিষ্কের বয়স। উদাহরণস্বরূপ, আপনার স্মৃতিশক্তি, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, মানসিক স্থিতিশীলতা এবং মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতার মাধ্যমে মস্তিষ্কের বয়স নির্ধারণ করা হয়।
অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে কোন বৃদ্ধ ব্যক্তি অনেক তরুণদের চেয়েও মেধাবী ও স্মার্ট উদাহরণস্বরূপ ফুটবল খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং কিছু সফল ব্যক্তি রয়েছেন যাদেরকে দেখানো যেতে পারে। অন্যদিকে, কিছু তরুণ বয়সের মানুষ দেখা যায় যারা প্রায়ই ভুলে যান, মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না এবং মানসিকভাবে বেশ ক্লান্ত এবং প্রায় ডিপ্রেশনে থাকেন তাদের নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ক্রিয়েটিভ ধারণা থাকে না। এর কারণ হলো তাদের মস্তিষ্কের বয়স তাদের শারীরিক বয়সের তুলনায় বেশি।
কোন কোন কারণে মস্তিষ্ক দ্রুত বুড়িয়ে যায়?
১. টানা মানসিক চাপ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ মস্তিষ্কের কোষগুলোর জন্য ক্ষতিকর। চাপের কারণে আমাদের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ যেমন হিপোক্যাম্পাস দ্রুত বুড়িয়ে যায়, ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয় ফলস্বরূপ অধিক ডিপ্রেশন এবং নতুন কিছু নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাওয়া।
২. অপর্যাপ্ত ঘুম: ঘুম আমাদের মস্তিষ্কের পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত জরুরি ঘুমের মাধ্যমে শরিলের বিভিন্ন কোষগুলির পুনঃগঠন এবং হরমোন নিঃসরণ হয় ব্রেইন বৃদ্ধি পেতে ঘুমের কোন বিকল্প নেই। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যা মস্তিষ্কের বয়সকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলে, বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা দৈনিক ঘুমানো প্রয়োজন, বিশেষ করে রাত ১১ঃ০০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া এবং খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা সুস্বাস্থ্যের জন্য এবং মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী।
৩. পর্যাপ্ত মানসিক চর্চার অভাব: মস্তিষ্ককে এক ধরনের পেশি হিসেবে ভাবা যেতে পারে। যেমন, শরীরচর্চা না করলে পেশি দুর্বল হয়ে যায়, তেমনি মানসিক চর্চার অভাবেও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।মানসিক চর্চা বলতে মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য যে সকল কার্যকরী পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো অনুসরণ করা, যেমন মেডিটেশন করা, ব্যায়াম করা, মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলা, সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি করারম, রুটিন মেনে কাজ করা ইত্যাদি হতে পারে।
কিভাবে বুঝবেন আপনার মস্তিষ্কের বয়স কেমন?
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মস্তিষ্কের বয়স জানতে পারেন এগুলো একটু ব্যয়বহুল হওয়াতে সকলের দ্বারা সম্ভব নয়, তবে অনেক রকমের অনলাইন কোয়িজ এবং মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে মস্তিষ্কের বয়স বোঝা যায়। এতে আপনার স্মৃতিশক্তি মনোযোগ ও চিন্তার গতি পরিমাপ করে একটি ধারণা দেওয়া হয়। এ সকল পদ্ধতি দ্বারা বিভিন্ন দিক থেকে পরীক্ষা করে দেখায় যে আপনার চিন্তা-ভাবনা কতটা তরুণ কিংবা কতটা বৃদ্ধ।
মস্তিষ্কের বয়স কমানোর উপায়:
১. নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক ব্যায়াম শুধু শরীরের জন্য নয়, মস্তিষ্কের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। আপনারা অনেক বয়স্ক সেলিব্রেটি এবং সফল ব্যক্তিত্বের মানুষদের দেখবেন যারা নিয়মিত শারীরিক চর্চা এবং মস্তিষ্ক চর্চা করেন যার ফলে তারা সব সময় কর্মঠ হয়ে থাকেন।
২. মেডিটেশন ও মানসিক চাপ কমানো: নিয়মিত মেডিটেশন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করলে মানসিক চাপ কমে, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। মেডিটেশন করার জন্য নিরিবিলি জায়গায় শান্ত হয়ে বসুন এবং চোখগুলো বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস প্রশ্বাস নিন এবং শ্বাস ছাড়ুন, সকল মনোযোগ আপনার শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে প্রতিস্থাপন করুন, এইভাবে কমপক্ষে ৫ মিনিট দৈনিক মেডিটেশন করুন, রীতিমতো চর্চা করলে তার ফলাফল অবশ্যই দেখতে পাবেন।
৩. খাবারে মনোযোগ দিন: এমন কিছু খাবার রয়েছে যা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী, যেমন - বাদাম, ব্লুবেরি, সামুদ্রিক মাছ, ডার্ক চকলেট, সবুজ সবজি ইত্যাদি। এগুলো মস্তিষ্কের কোষকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। তবে অবশ্যই অতিরিক্ত তৈলযুক্ত খাবার এবং লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করুন এগুলো স্বাস্থ্যর জন্য এবং মস্তিষ্কের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।
৪. নতুন কিছু শিখুন: নতুন ভাষা শেখা, বই পড়া, সঙ্গীত শেখা, কিছু মস্তিষ্কের গেম রয়েছে সেগুলো খেলা বা কোন নতুন দক্ষতা অর্জন করলে মস্তিষ্ক সক্রিয় এবং কার্যকরী বৃদ্ধি করে। মস্তিষ্কের কোষগুলো নতুন তথ্য ধারণের সময় নতুন নতুন সংযোগ তৈরি করে মস্তিষ্ককে তরুণ রাখতে সাহায্য করে।
৫. সঠিক ঘুমের অভ্যাস তৈরি করুন: পর্যাপ্ত ঘুম এবং ঘুমের রুটিন ঠিক রাখা মস্তিষ্ককে পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। রাতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ঘুম হওয়ার জন্য আপনার রুমটি নিরিবিলি শান্ত এবং অন্ধকার ময় একটি রুম নির্বাচন করুন, এবং নিশ্চিত করুন ঘুমানোর পোশাকটি যেন খুবই আরামদায়ক হয়, ঘুমানোর আগে কোনরকম চা-কফি ক্যাফেইনযুক্ত খাবার খাওয়া যাবেনা এবং সকল প্রকার ডিভাইস কমপক্ষে ১ ঘন্টা আগে ব্যবহার করা পরিহার করুন। এতে খুব ভালো একটি ঘুম হবে।
৬. মানসিক গেম খেলুন: সৃষ্টিশীলতা এবং মেমোরি বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের মানসিক গেম যেমন দাবা, পাজল, রুবিক্স কিউব এর সূত্র মিলানো, শব্দ খেলার মত গেম গুলি খেলতে পারেন। এগুলো মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে সক্রিয় রাখে মস্তিষ্ক বৃদ্ধি করার জন্য এগুলি একটি কার্যকর পদ্ধতি।
মস্তিষ্কের বয়স নিয়ে কিছু ভুল ধারণা:
কিছু ভুল ধারণা আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে, যেমন:
মস্তিষ্ক শুধুমাত্র বয়স বৃদ্ধির সাথে দুর্বল হয়: অনেকেই মনে করেন, বয়স বাড়লেই মস্তিষ্ক দুর্বল হবে। আসলে শারীরিক বয়স বৃদ্ধির সাথে মানসিক দুর্বলতা আসা জরুরি নয়, বরং আমরা কিভাবে জীবনযাপন করছি এবং কি খাচ্ছি এগুলোর ওপর নির্ভর করে আপনার মস্তিষ্কের বয়স বৃদ্ধি, যেমনটা আমি আগেও বলেছিলাম যে বয়স্ক সেলিব্রেটিরা তাদের দৈনন্দিক উন্নত স্বার্থপর জীবনযাপন এবং অভ্যাসগুলি দ্বারা এখনও তাদের মস্তিষ্কের অ্যাক্টিভিটি ধরে রাখতে পেরেছেন।
শুধু তরুণদের মস্তিষ্কই দ্রুত কাজ করে: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধারণাটি ভুল। প্রাপ্তবয়স্করাও সঠিক চর্চা, মানসিক উদ্দীপনা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে তাদের মস্তিষ্ক বেশ তেজস্বী হতে পারে। এর জন্য আপনার দৈনন্দিন বদ অভ্যাসগুলো পরিহার করে স্বাস্থ্য এবং মস্তিষ্ক সচেতন বৃদ্ধি করতে হবে, তাহলেই আপনার মস্তিষ্কের বয়স কমিয়ে ফেলা সম্ভব হবে এবং বৃদ্ধ বয়সেও আগের মত মস্তিষ্ক কাজ করবে।
আমাদের মস্তিষ্কের বয়স শুধু আমাদের বয়স নির্ভর করে না, বরং আমাদের অভ্যাস, মানসিক চাপ, জীবনযাপন এবং চিন্তাভাবনার ওপরও নির্ভর করে। প্রতিদিন কিছুটা সময় মস্তিষ্কের যত্নে ব্যয় করলে এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুললে পারলেই আমরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মস্তিষ্ককে তরুণ রাখতে পারব। চলুন না আজ থেকে আমরা একটু সচেতন হই এবং আমাদের মস্তিষ্কের বয়স কমাতে একসাথে কাজ শুরু করি!