অনেকেই আজকাল একটা অজানা ভয়, টেনশন বা চাপের মধ্যে থাকেন এবং এটা থেকে শুরু হয় হতাশা কাজে মনোযোগ না থাকা । কখনো কোনো কারণ ছাড়া বুক ধড়ফড় করে, নিশ্বাস আটকে আসে, মাথা ভার লাগে এইসবই হতে পারে অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগের লক্ষণ। বাংলা ভাষায় একে আমরা বলি মানসিক চাপ বা উৎকণ্ঠা বলে অনেকের কাছে পরিচিত এই শব্দটি। তবে মাঝে মাঝে একটু চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যখন এই দুশ্চিন্তা বারবার আসে, তখন তা শরীর ও মন দুটোরই ক্ষতি করতে পারে সাথে আপনার কাজে কিংবা পড়ালেখায় ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
অ্যাংজাইটি কি? সহজ করে বললে, এটা এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্ক আমাদের বিপদের সংকেত দিতে থাকে, যদিও বাস্তবে সেই বিপদটা হয়তো নেইও। কেউ কেউ খুব সাধারণ বিষয়েও ভয় পেয়ে যান যেমন “অফিসে কথা বলা,” বাসে ওঠা, বা পরীক্ষার আগে চিন্তায় ভেঙে পড়া। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অ্যাংজাইটির প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের ১৫–৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায় ২০% মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগে ভোগেন। COVID-19 এর সময় এই সংখ্যা আরও বেড়েছিল কয়েক গুণ।
কিন্তু উদ্বেগ থাকলেই কি সেটা রোগ? সবসময় না। তবে যদি এই অনুভব প্রতিদিন হয়, যদি ঘুম নষ্ট করে দেয়, কাজে মনোযোগ দিতে না দেয়, বা শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করায় তাহলে সেটি উদ্বেগ ব্যাধি বা Anxiety Disorder হিসেবে ধরা হয়। এ ধরনের অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে আগে বুঝতে হবে কোন কোন লক্ষণ দেখা দিলে সাবধান হওয়া দরকার। যেমনঃ বারবার ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড়, হাত-পা ঠান্ডা লাগা, মাথা ঘোরা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া কিংবা ঘুমে বিঘ্ন হওয়া। এসব লক্ষণ প্রতিদিন অনুভব করলে মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে ধারায়।
এখন প্রশ্ন আসে অ্যাংজাইটি দূর করার উপায় কী? ভালো খবর হলো, কিছু সহজ অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমেই উদ্বেগ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। প্রথমেই আসে ব্যায়ামের কথা। প্রতিদিন অন্তত ২০–৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামের সুখ হরমোন বাড়ে। এটা শুধু মন ভালো করে না, বরং উদ্বেগও কমায় অনেকাংশেই। মেডিটেশন বা ধ্যান একটি চমৎকার উপায় প্রথমে আপনার চোখ বন্ধ করুন গভীরভাবে শ্বাস নিন, মনের কথা শুনতে শিখুন, এভাবেই ধীরে ধীরে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। যারা দিনে ১০ মিনিটও নিয়মিত এই অভ্যাস চালিয়ে যান, তারা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি শান্ত থাকেন এবং তাদের মনোযোগ শক্তি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে।

ঘুম ঠিকমতো হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাত জেগে মোবাইল ঘাঁটা বা কাজ করতে করতে ভোর হওয়া অ্যাংজাইটি বাড়িয়ে দিতে পারে, যেটা বর্তমানে বিশেষজ্ঞদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়েছে। বরং প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন। ঘুম ভালো হলে মনও ভালো থাকবে। একইভাবে খাবারও প্রভাব ফেলে। অনেকেই কফি বা চা অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন, যা মস্তিষ্ককে অস্থির করে তোলে। তাই উদ্বেগ কমাতে চাইলে মসলাদার খাবার, অতিরিক্ত চিনি, ক্যাফেইন ও ধূমপান কমিয়ে আনতে হবে।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ অনেক কাজে দেয়। কারও সঙ্গে কথা বললে, মনের ভেতরের দুশ্চিন্তা অনেকটাই হালকা হয়ে যায়। বিশেষ করে পরিবার, বন্ধু বা কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষকে নিজের অনুভব জানানো খুব জরুরি সাবার জন্য। আপনি যা অনুভব করছেন, সেটা কেউ শুনছে এই ব্যাপারটাই আপনার মনে অনেক শান্তি দেয়। আবার কেউ যদি ভয় পায় চিকিৎসকের কাছে যেতে, তাহলে তারা অনলাইনে নানা উৎস থেকে তথ্য নিতে পারেন, তবে চিকিৎসা নিতে হলে অবশ্যই একজন ভালো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিজেকে ক্ষমা করতে শেখা। অনেক সময় আমরা ভুল করলেই নিজের ওপর রাগ করি, হতাশ হয়ে যাই এটা নিয়ে নিজেকে ছোট মনে করতে থাকি। অথচ ভুল করাটাও শেখার একটা অংশ। তাই নিজের প্রতি একটু সদয় হওয়া আপনার জন্য খুবই জরুরি। নিজের পছন্দের কিছু করা যেমন: গান শোনা, বই পড়া, ছোট ভ্রমণে যাওয়া, বা ছবি আঁকা এসবই মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। আবার যারা সবসময় নেতিবাচক কথাবার্তা বেশি বলে থাকে তাদেরকে এড়িয়ে চলুন।
অ্যাংজাইটি যদি খুব বেশি বেড়ে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের দরকার হতে পারে। তবে উদ্বেগ কমানোর ওষুধ সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত। নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাও ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন শরীরের চিকিৎসা। অনেকেই ভাবেন, মানসিক সমস্যার কথা বললে লোকে খারাপ ভাববে। কিন্তু আজকের দিনে এটি একেবারেই স্বাভাবিক, এবং সমাজও এখন অনেক বেশি সচেতন এই বিষয়ে।
সবশেষে একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি, উদ্বেগ আমাদের সবার জীবনেরই অংশ। এটিকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারবো না। কিন্তু আমরা চাইলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, নিজের জীবনটাকে আরেকটু সহজ করে তুলতে পারি। একদিনে হবে না, কিন্তু প্রতিদিন একটু করে চেষ্টা করলে সেই শান্তির জায়গাটা ধীরে ধীরে ধরা দেবে আমাদের জীবনে।