বাংলাদেশে যারা অনলাইন টিকিট বুকিং করেন, তাদের অনেকেই “ফ্লাইট এক্সপার্ট” নামটা চেনেন । কম খরচে টিকিট, হোটেল বুকিং আর ট্যুর প্যাকেজের সুবিধা দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন সবকিছু বদলে গেছে। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ওয়েবসাইট কাজ করছে না, অফিসে তালা, আর মালিকদের খোঁজ মিলছে না। হাজার হাজার গ্রাহক আর ট্রাভেল এজেন্সি এখন দুশ্চিন্তায়। কেউ কেউ লাখ লাখ টাকা হারিয়েছেন।
মূলত ”ফ্লাইট এক্সপার্ট” গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে বিমান টিকিট বুক করত। কিন্তু অনেক সময় তারা সরাসরি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে লেনদেন করত না। বরং কিছু মধ্যস্থ এজেন্সির মাধ্যমে কাজ চালাত। এই মাধ্যমগুলো এখন অনেক জায়গায় তাদের দায় নিচ্ছে না। তারা বলছে, ফ্লাইট এক্সপার্ট সময়মতো টাকা দেয়নি। ফলে এখন যেসব টিকিট কনফার্ম হয়নি, সেগুলোর অর্থও আর ফেরত আসছে না।
বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি ও সাধারণ গ্রাহক এখন মতিঝিল অফিসের সামনে ভিড় করছেন। অনেকেই বলছেন, তাদের ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আটকে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, টিকিট নেওয়ার পরে তারা বুঝতেই পারেননি সেটি সরাসরি ফ্লাইট এক্সপার্টের নয়, কোনো থার্ড পার্টি এজেন্সির মাধ্যমে বুক করা।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে একটি প্রতারণার মামলা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে “প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকার মতো অর্থ আত্মসাৎ করেছে”। এর মধ্যে শুধু সরকার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের একটি এজেন্সিরই ক্ষতি প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো। পুলিশ এ মামলায় এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন: ফাইন্যান্স প্রধান সাকিব হোসেন, কমার্শিয়াল প্রধান সাঈদ আহমেদ এবং অপারেশনস প্রধান সাদাত হোসেন।
মালিক সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম এবং তাঁর বাবা এম. এ. রশিদ শাহ সম্রাট এখনো পলাতক। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা দেশের বাইরে চলে গেছেন। কেউ কেউ বলছেন, অফিস বন্ধ হওয়ার আগেই তাঁরা মালয়েশিয়া বা দুবাইয়ের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন। যদিও তাঁদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ সময় ইউনিয়ন ট্রাভেলস নামের একটি এজেন্সির মালিক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “সব শেষ ভাই, আমার ভাই ২৫-৩০ লাখ টাকা নাই। আমি শেষ।” তাঁর সবগুলো টিকিটই ফ্লাইট এক্সপার্টের মাধ্যমে কাটানো ছিল। কিন্তু এসে শুনেছেন, সেগুলো মূলত তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নেওয়া টিকিট।
এই সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। জানা গেছে, ফ্লাইট এক্সপার্ট নিজেরা কখনোই সরাসরি এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে টিকিট কিনত না। তারা দুটি মধ্যস্থ এজেন্সির মাধ্যমে কাজ করত। এখন সেই দুটি এজেন্সি রিফান্ডের মাধ্যমে অর্থ তুলে নিচ্ছে, অথচ গ্রাহকেরা টাকা পাচ্ছেন না।

এই দুরবস্থার মধ্যেও ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান বিন রশিদ এক অভ্যন্তরীণ ফেসবুক গ্রুপে দাবি করেন দুইজন কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাই তিনি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেশ ছাড়ছেন। তবে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে দেওয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, “গ্রাহকেরা সঙ্গে সঙ্গেই টিকিট পেতেন তাই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই এইখানে।”
এদিকে ফ্লাইট এক্সপার্টের কমার্শিয়াল হেড সাঈদ আহমেদ এক ভিন্ন বক্তব্য দেন গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে। তিনি বলেন, মালিকপক্ষই মূল টাকা তুলে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এইখানে তাদের কিছু করার ছিল না। তিনি আরও জানান, তাঁরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। সেখানে উল্লেখ রয়েছে “সালমান পরিবারসহ কাউকে কিছু না জানিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন।”
অফিস ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, সালমান অফিসে নিয়মিত যেতেন, কিন্তু কয়েকদিন ধরে অনুপস্থিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “ছোট এজেন্সিগুলো বড় প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভর করেই চলে। এই নির্ভরতাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।”
এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় বাংলাদেশের অনলাইন ভ্রমণ সেবাখাত কতটা অনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। একদিনে একটি প্রতিষ্ঠান হারিয়ে যেতে পারে, আর ক্ষতিটা শুধু হয় সাধারণ মানুষদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতটিকে এখনই নীতিমালার আওতায় না আনলে সামনে আরও বড় বিপর্যয় আসতে পারে। গ্রাহকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কঠোর নজরদারি, দ্রুত প্রতিকার ব্যবস্থা এবং প্রকৃত দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।