আজ রাতেই ব্লাড মুন আকাশজুড়ে রক্তিম পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ

A large, vivid red moon rises against a stark black sky above a silhouetted horizon with faint grass and plants, creating a mysterious, dramatic ambiance. চন্দ্রগ্রহণ. blood moon. ব্লাড মুন.

আজ রাতের আকাশে বিরল এক দৃশ্য দেখা যাবে। রাতের আকাশে ‘ব্লাড মুন’ বা রক্তিম চাঁদের পূর্ণগ্রহণ হবে। আগামী ৭–৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ এর মধ্যরাতে পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদের মধ্যে সোজা সারিতে এসে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে। এই সময় চাঁদ লালচে হয়ে উঠবে, তাই এ ঘটনাটিকে রক্তিম চাঁদ বলা হয়। বাংলাদেশের আকাশ থেকেও এই রঙিন চাঁদের আলোকচ্ছট দেখা যাবে। চাঁদ তখন নরম গোলাপি কিংবা মেরুন রঙ ধারণ করবে, পুরো আকাশ বিরল এক মাধুর্যে আলোকিত হবে।

চন্দ্রগ্রহণ কী?

চন্দ্রগ্রহণ হল যখন পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের ঠিক মাঝখানে এসে সূর্যের আলো চাঁদের ওপর পড়ার পথ বাধাগ্রস্থ করে। এই অবস্থায় পৃথিবীর ছায়াটি চাঁদের ওপর পড়ে যায়। সম্পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ পুরোপুরি পৃথিবীর ছায়ার আড়ালে চলে যায়। অর্থাৎ, পৃথিবী যখন সূর্য থেকে আসা আলোকে পুরোপুরি আটকিয়ে দেয়, তখন চাঁদের ওপর আর সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না। এ সময় চাঁদ মলিন হয়ে যায় এবং ঘনবাদল প্রকৃতির আলো-চিত্র বদলে গিয়ে আমরা চাঁদটিকে লালাভ দেখব।

পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের তিনটি পর্যায় আছে – প্রথমে পৃথিবীর বাইরের ছায়ায় (উপচ্ছায়া) চাঁদ ঢেকে, পরে আংশিকভাবে ঢেকে, সবশেষে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এর শেষ পর্যায়েই চাঁদ লালচে দেখা যায়। এই পুরো ঘটনাকে মানুষ ধরে চন্দ্রগ্রহণ। আমাদের চোখ খোলা থাকলেই চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়, টেলিস্কোপের দরকার পড়ে না। ছোট্ট শিশু থেকে বড় কেউ ঘরের উঠোনে বা ছাদে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে পারে এই মহাজাগতিক রূপকাঠামো।

আজকের চন্দ্রগ্রহণের সময়সূচী

এই সপ্তম-অষ্টম সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী রাতেই পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত নয়টা ২৮ মিনিটে শুরু হবে এই গ্রহণের প্রথম পর্যায় (জ্যোতিষশাস্ত্রে যাকে পেনুম্ব্রাল গ্রহণ বলে)। এরপর রাত ১১টা ৩০ মিনিটে শুরু হবে পূর্ণগ্রহণ। রাত ১২টা ১১ মিনিট নাগাদ চাঁদ সবচেয়ে গাঢ় লাল হবে। এই গাঢ় রঙের অবস্থাটি প্রায় ৪১ মিনিট ধরে থাকবে। রাত ১২টা ৫২ মিনিট নাগাদ পূর্ণগ্রহণ শেষ হবে। এইভাবে বাংলাদেশে মোট প্রায় ৮২ মিনিট ধরে রক্তিম চাঁদ দেখা যাবে।

পুরো ঘটনাটি প্রায় সাত ঘণ্টা ২৭ মিনিটেরও বেশি স্থায়ী হবে (শুরু থেকে শেষে পেনুম্ব্রালসহ)। তবে মানুষের নজরে সবচেয়ে সুন্দর লাগে পূর্ণগ্রহণের সেই ৮২ মিনিটের লালাভ চাঁদ। কেউ যদি পুরোসময়ের প্রত্যক্ষ অবলোকন করতে চান, রাত ১১টা ৩০ থেকে রাত ১২টা ৫২ পর্যন্ত বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। রাত সাড়ে ১২টার পর থেকে চাঁদ আবার স্বাভাবিক উজ্জ্বল সাদা হয়ে উঠবে।

A sequence of four moon phases during a lunar eclipse against a starry night sky. The transition goes from full moon to red-hued blood moon.
lunar eclipse

রক্তিম চাঁদ কেন?

পূর্ণগ্রহণের সময় চাঁদের রঙ কেন লাল হয়, সেটা খুবই মজার বর্ণালঙ্কারিক ঘটনা। সূর্যের আলো সাতটি রঙের সমন্বয়ে গঠিত হলেও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেসব রশ্মি গহীন চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়, তা লাল ও কমলা রঙের রশ্মি। বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণা, জলকণা ও গ্যাস নীল এবং সবুজ রঙের আলোকে খসে ফেলতে সাহায্য করে। ফলে পৃথিবী থেকে আসা আলোটি লালাভ বর্ণে পরিপূর্ণ থাকে এবং যেটুকু রশ্মি চাঁদে পৌঁছায় তার মধ্যে লাল রঙের আলোই প্রধান থাকে। তাই মাটিতে বসে অনেকের চোখে যতক্ষণ রক্তিম চাঁদ উজ্জ্বল, মনে হবে যেন একটি সবুজ কিচিরমিচির আলোর ঝলকানি আকাশে বিরাজ করছে। গাঢ় লাল রঙের এই চাঁদ দেখতে যাকে Blood moon বলে।

গত পূর্ণগ্রহণের সময় যেমন ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর রক্তিম চাঁদ দেখা গিয়েছিল, এবারও ঠিক সেই মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে। ২০২২ সালে যখন এই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, তখন উত্তরের অনেক দেশে ও বাংলাদেশেও দেখা গেছে। এবার ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে আবার এই নীল সূর্য-রক্ত চাঁদ মিশ্রণ দেখা যাবে। সাধারণ পূর্ণিমার চেয়ে এই চাঁদের আকার কিছুটা বড় (সুপার চাঁদ বলে) এবং উজ্জ্বলতাও প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি হবে। তাই বিজ্ঞানীরা এই চন্দ্রগ্রহণটিকে ‘সুপার ব্লাড মুন’ও বলেছেন।

কোথায় দেখা যাবে?

এবারের চন্দ্রগ্রহণ খুব বিশাল এলাকা থেকে দেখা যাবে। এশিয়া এবং পূর্ব অস্ট্রেলিয়া থেকে পুরো ঘটনাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া সময়সূচী অনুযায়ী এটা পুরোপুরি দৃশ্যমান হওয়াতে আমরা এখান থেকেও উপভোগ করতে পারব। সাধারণত, এই দৃশ্য শুধু পূর্ণিমার রাতেই চোখে লাগে। তবে দেশের অনেক জায়গা মেঘলা হলে দেখা নাও যেতে পারে। তাই ঝকঝকে কোনো সন্ধ্যা বেছে নিতে বলা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বড় অংশে আজকের এই রক্তিম চাঁদের চাঁদাবাজি দেখা যাবে। তবে ইউরোপের অনেকখানি এলাকা পূর্ণগ্রহণের সময় আকাশে উঠছে, ফলে পূর্ব দিকের উচ্চতায় চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অস্থির লালাভ রঙ দেখা যেতে পারে। আমেরিকার বংশোদ্ভূত এলাকায় এই রাতে চাঁদ উপলব্ধি হয় না কারণ সেখানে চাঁদ অস্ত যাওয়ার সময়ই এটি ঘটছে। তবে চিন্তা নেই, বছর শেষে ২০২৬ সালের মার্চে আমেরিকা থেকেও ব্লাড মুনের পূর্ণগ্রহণ দেখা যাবে।

বাংলাদেশে রাত ১১টার পর আকাশ পরিষ্কার থাকলেই যে কেউ Blood moon দেখার সুযোগ পাবে। ঢাকার মত আলোকদূষণ কম এলাকা থেকে চাঁদটি সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। গ্রামের গ্রাম-খামারে উঠোনে দাঁড়ালে, শান্ত শীতল বাতাসের মাঝে আলো যেন গাঢ় পানিতে পড়ছে তেমন ম্যাজিক দেখাবে চাঁদ। পাখির ডাক, দূরের ঘণ্টাধ্বনি সহ সব কিছুকেই বিলুপ্ত করে ফেলবে আকাশের স্নিগ্ধ মেরুনিমা।

A large, vivid red moon rises against a stark black sky above a silhouetted horizon with faint grass and plants, creating a mysterious, dramatic ambiance.
Moon lunar eclipse

কীভাবে উপভোগ করবেন?

চন্দ্রগ্রহণ দেখা অত্যন্ত সহজ। ছোট্ট কোনো টেলিস্কোপ, বাইনোকুলার না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। শুধু আকাশ পরিষ্কার অবস্থায় এবং যাদের বাড়ির ছাদ কিংবা উঠোন খোলা আছে, তারা একটু চেয়ে রাখলেই হবে। মন খুলে আকাশের দিকে তাকান – ফিল্টার বা বিশেষ চশমা ছাড়াই কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ এই মুহূর্তে চাঁদের আলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো ঝলমলে আলোর ক্ষতিকর কিরণ আমাদের চোখে পৌঁছায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও পরামর্শ দিয়েছে, শহরের আলো কম থাকা অন্ধকার কোনো শান্ত জায়গা থেকে চন্দ্রগ্রহণ দেখলে সবচেয়ে ভালো হয়। ঢাকার বাইরে কিংবা শান্ত কোনো পার্ক-খেয়াঘাটে ঘুরতে গেলেই রাতের আকাশের ন্যায় মাখামাখি নীলপট যেন লাল আভায় সেজে উঠবে। পুরো অভিজ্ঞতাটাই হয় জাদুর মতো: সহজ-সরল, মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তাই পরিবার-বন্ধু নিয়ে দাঁড়িয়ে রাত্রির এই নৈসর্গিক উপহার উপভোগ করুন।

চন্দ্রগ্রহণের কোনও ধোঁকাবাজি নেই, চোখের কোনও ক্ষতি হয় না। ছোট বাচ্চারা এখন নিশ্চিন্তে ঠাণ্ডা বাতাসে চাঁদ দেখতে পারে। আকাশের এই ঘটনা তোলপাড় করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও, সবাই এই সন্ধ্যা গণমাধ্যমে লাইভ দেখছে। কেউ বাড়ির ওপারে চা খেতে খেতে, কেউ ঘরের ছাদে বসে। লোককথা নেই, বিজ্ঞান দেখানোর প্রতীক্ষায় আকাশ ফাঁকা রাখুন শুধু।

পৌরাণিক বর্ণনা অনেক আছে চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে, তবে এ বৃত্তান্ত আমাদের ক্ষেত্রেই প্রকৃত বিজ্ঞান ও সময়ে তথ্যের কথাই। মনে রাখবেন, প্রতি কয়েক বছর অন্তর এমন পূর্ণগ্রহণ হয়। চল্লিশ বছর আগের কথা স্মৃতিতে ফেরান তখন টেলিভিশনেও সম্প্রচার হতো, গণজাগরনের বিষয় হতো। এখন আমাদের তো হাতের ফোনেও জানিয়ে দিচ্ছে যে আজ রাত সাড়ে ১১টার পর চাঁদ লাল হবে!

সুতরাং রাতের আকাশ দিকে তাকিয়েই দেখুন আজকের চন্দ্রগ্রহণ। কিছু লোকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে যে চাঁদের দিকে তাকালে চোখ নষ্ট হবে, কিন্তু তা নয়। চাঁদের আলো অত্যন্ত নরম – রোদ-বাতাসের আলো তুলনায় অনেকই কম। তাই সরাসরি তাকালেও সমস্যা নেই। এমনকি মোবাইলে ক্যামেরা চালিয়ে রাখলেও ছবিতে লাল চাঁদ ফুটিয়ে দেখা যাবে।

বিজ্ঞান ও কৌতূহল মিশিয়ে আজকের এই রাত উপভোগ করুন। বাংলায় এই নামেই প্রচলিত ব্লাড মুন চন্দ্রগ্রহণের ভাঁজে রয়েছে প্রকৃতির অপার রহস্য। সূত্রমতে, গতবারের রক্তিম চাঁদ ছিল ২০২২ সালের নভেম্বরে এবং এখন ফের আসছে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের এই রাতেই। নাগালের কাছে আসা এই মহাজাগতিক চমক যেন আপনাকে বড় এক আনন্দ দান করে। মনে রাখবেন, রাত ১১টার পর পরিষ্কার আকাশ হলে মেগাআউটডোর সাইকেল, বেড়ে বসে বা বারান্দায় চিল্লে চিল্লে এই রক্তিম চাঁদের সাক্ষী হতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top